এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সচরাচর ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। বাংলাদেশে করোনার মাঝে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ। বছরের প্রথম থেকে ডেঙ্গু জ্বরের বৃদ্ধি থাকলেও বর্ষাকালের আগমনে তা দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। এদিকে দেখা যাচ্ছে করোনা ও ডেঙ্গু জ্বরের মধ্যে লক্ষণ বা উপসর্গগত কিছু মিল থাকার কারণে এ সময় সাধারণ একটু জ্বর হলেই মানুষ করোনার ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠছেন।
তো চলুন আজ জেনে নিই ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষন ও কারনসমূহ এবং কি কি প্রদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
ডেঙ্গু জ্বর হওয়ার কারনঃ
ডেঙ্গু যেহেতু ভাইরাসের আক্রমণে হয়ে থাকে কাজেই বলা যায় এটি ভাইরাসঘটিত রোগ। আর এই ভাইরাসের জীবাণুর নাম ফ্ল্যাভিভাইরাস বা ডেঙ্গি ভাইরাস। ডেঙ্গী ভাইরাই হলো মূলত আর এন ই ভাইরাস । আর এই ভাইরাসের বাহক হলো স্ত্রী মশা বা মসকী, আর ডেঙ্গু ভাইরাসের পোষক হলো মানুষ ।
আমরা হয়তো জানি, মশাকে বংবিস্তার করতে হলে অবশ্যই রক্তের প্রয়োজন হয় , আর মশা এসব রক্ত মানুষসহ বিভিন্ন পশু পাখি থেকে সংগ্রহ করে। যেহেতু ডেঙ্গি ভাইরাসের পোষক হচ্ছে মানুষ তাই মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রানী কে এই ভাইরাস আক্রমন করে না। কোনো মশকী মানুষের শরীর থেকে রক্ত সংগ্রহ করার সময় মশা থেকে এই ডেঙ্গি ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে এবং পরে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়।
তাই আমাদের দিনের বেলায় মশার কামড় হতে নিরাপদে থাকতে হবে, কেননা অধিকাংশ মশকীগুলো দিনের বেলায় কামড়ায়।
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষনঃ
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষন প্রধানত ৩ প্রকার হয়ে থাকে । যথাঃ
- সাধারন ডেঙ্গুজরঃ এই জ্বরের লক্ষন হলো প্রথমে শীত শীত ভাব হয়ে হঠাত প্রচন্ড জ্বর দেখা যায়। এই জ্বর মশকীর কামড়ের ২-৭ দিন পর দেখা যায় এবং জ্বর সাধারনত ১০৩-১০৫ ডিগ্রি ফারেহাইটের মধ্যে হয়ে থাকে । এ সময় তীব্র মাথা ব্যথা , চোখের পেছনে ব্যথা , পেট ব্যথা, কপাল ব্যথা, গলা ব্যথা সহ বিভিন্ন কিছু লক্ষন দেখা যায়।ডেঙ্গু জ্বরের বিশেষ লক্ষন হচ্ছে মেরুদন্ডের ব্যথা সহ কোমরের ব্যথা। তাছাড়া শরীরে লালচে রঙ্গের র্যাশ বা ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে , বমি বমি ভাব ও খাবারের অরুচী হতে পারে। মারাত্নক পর্যায়ে পৌছলে রক্তক্ষরণও হতে পারে।
- হেমোরেজিক ডেঙ্গুজরঃ সাধারন ডেঙ্গুজ্বরের জটিলতা থেকে এটির উৎপত্তি হয়। এতে কয়েকদিন পর রোগীর নাক, মুখ, দাঁতের মাড়ি ও ত্বকের নিচে রক্তক্ষরন দেখা যায়। পায়খানার সাথে রক্ত যেতে পারে এবং রক্তবমি হতে পারে। রক্তের পেটিলেট হ্রাস পায় এবং এতে করে রক্ত জমাট বাধতে পারে না । সঠিক চিকিৎসার অভাবে অনেক ক্ষেত্রে রোগী মারাও যায়।
- ডেঙ্গু শক সিন্ড্রমঃ এটি হচ্ছে ডেঙ্গু জ্বরের চরম পর্যায় এক্ষেত্রে ডেঙ্গু জ্বরে বুকে-পেটে পানি জমে ও ফুসফুসে পানি জমে শ্বাসকষ্ট হয়। কিন্তু প্রথম থেকে ঠিকমতো চিকিৎসা করালে এবং সঠিক পরিমাপে তরল পদার্থ দিতে পারলে ডেঙ্গু মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে না। এ পর্যন্ত যাদের ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যু হয়েছে, তাদের মধ্যে ৬৮ শতাংশেরই ডেঙ্গু শক সিনড্রোম ছিল
ডেঙ্গুজ্বরের প্রতিকারঃ
রোগীকে প্রচুর পানি, ফলের রস ও তরল খাবার দিতে হবে । মাথায় পানি দেওয়া , গায়ের ঘাম মুছে দেওয়া, ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর স্পঞ্জ করে দেওয়া রোগির জন্য ফলস্বরূপ হয়। দুগ্ধপোষ্য শিশুদের অবশ্যই বোকের দুধ খাওয়াতে হবে।
ডেঙ্গুজ্বরে রোগীতে এসপিরিন জাতীয় ঔষধ প্রয়োগ মারাত্নক পরিণতি দেখা দিতে পারেন , তাই এসপিরিন জাতীয় ঔষদ দেওয়া যাবে না ।ব্যথা ও জ্বর কমানোর জন্য পেরাসিটামল জাতীয় ঔষদ দিতে হবে। তাছাড়া, রক্তের সাম্যতা রক্ষার জন্য প্লেটিলেট ট্রান্সফিউশনের দরকার পড়ে।
কিছু প্রশ্ন
১.জ্বর হলেই কি পদক্ষেপ নিতে হবে?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এবিএম আবদুল্লাহ বলছেন, ” যারা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন, তারা জ্বরকে অবহেলা করেছেন। জ্বরের সাথে সর্দি- কাশি, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া কিংবা অন্য কোন বিষয় যদি জড়িত থাকে তাহলে সেটি ডেঙ্গু না হয়ে অন্যকিছু হতে পারে। তবে জ্বর হলেই সচেতন থাকতে হবে।” জ্বরে আক্রান্ত হলেই সাথে-সাথে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ।
২.বিশ্রামে থাকতে হবে
ড. সানিয়া তাহমিনা(সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক) বলেন, ”জ্বর হলে বিশ্রামে থাকতে হবে” এবং তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন, “জ্বর নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করা উচিত নয়। একজন ব্যক্তি সাধারণত প্রতিদিন যেসব পরিশ্রমের কাজ করে, সেগুলো না করাই ভালো। পরিপূর্ণ বিশ্রাম প্রয়োজন।”
৩.ডেঙ্গুর লক্ষন প্রকাশ পেলেই কি হাসপাতালে ভর্ত হতে হবে?
সাধারন ডেঙ্গুজরের লক্ষন দেখা দিলে সাবধানে থাকা উচিত এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে খাওয়া দাওয়া ও সেবা নেওয়া উচিত । কিন্তু যদি জ্বরের প্রভাব বেড়ে হেমোরিজিক কিংবা ডেঙ্গু শক সিন্ড্রম এ চলে যায় তখন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যথাযথ চিকিৎসা নেওয়াই ভালো হবে।
আরো পড়ুনঃ